ঈশ্বরদী ও পাকশী: পাবনার প্রাণকেন্দ্রে এক সমৃদ্ধ জনপদ।

  • আপডেটের সময়: রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫
  • ১৩৫ সময় দেখুন

স্টাফ রিপোর্টার : আব্দুল হান্নান

পাবনা জেলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ঈশ্বরদী উপজেলা, যা বাংলাদেশের রেলের শহর এবং পাবনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, এক সমৃদ্ধ জনপদ। এই অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উন্নত জীবনযাত্রা, কর্মঠ মানুষ এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বরদীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পাকশীর ভূমিকা অনস্বীকার্য, যা তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলার একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এখানে বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ করেন, যার মধ্যে বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন, বৃহত্তম রেলওয়ে ব্রিজ এবং একটি বিমানবন্দর উল্লেখযোগ্য। এই অবকাঠামোগুলো ঈশ্বরদীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান আমলেও এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ছিল, যখন এখানে ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ এবং নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঈশ্বরদী প্রথমে একটি থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ‘উন্নয়ন সার্কেল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ উপজেলা হিসেবে নামকরণ করা হয়। ঈশ্বরদীর নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত থাকলেও, অধিকাংশের মতে ঈশা খাঁর আমলের ‘ঈশা’ এবং ‘ডেহী/কাঁচারী’ শব্দের সমন্বয়ে ‘ঈশ্বরদী’ নামের উৎপত্তি।

ঈশ্বরদী উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরে নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম ও লালপুর উপজেলা, পশ্চিমে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা, দক্ষিণে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা এবং পূর্বে পাবনা সদর ও আটঘরিয়া উপজেলা অবস্থিত। এই উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে খরস্রোতা পদ্মা নদী, যা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ঈশ্বরদী বাংলাদেশের উষ্ণ অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত, যা এখানকার কৃষি বৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলে। ঈশ্বরদীতে শিক্ষার পরিবেশ বেশ উন্নত। এখানকার শিক্ষার হার ৮৯.৭%, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। পুরুষদের শিক্ষার হার ৮৭.০% এবং মহিলাদের ৯৬.২%। এখানে ১৫টি কলেজ, ৬১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, ১টি কৃষি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট, ৯১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি কমিউনিটি বিদ্যালয়, ২৫টি কেজি স্কুল এবং ১৮টি মাদ্রাসা রয়েছে।

ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ (১৯৬৩), ইক্ষু গবেষণা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৮১) এবং সাঁড়া মাড়োয়ারী স্কুল অ্যান্ড কলেজ (১৯১৭), ঈশ্বরদীর সরকারী রেলওয়ে নাজিমুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সহায়তা করছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে, ঈশ্বরদীতে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, যা স্থানীয় জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ করে। এছাড়াও, বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। যদিও মাঝে মাঝে জনবল সংকট এবং কিছু অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়, তবে সামগ্রিকভাবে ঈশ্বরদীর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এলাকার মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।

ঈশ্বরদীর যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত, যা এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পদ্মানদীর উপর নির্মিত লালন শাহ্ সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সাথে উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের যোগাযোগকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত করেছে। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন, যা দেশের রেল যোগাযোগের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। ব্রিটিশ আমল থেকেই এটি উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সড়কপথেও ঈশ্বরদীর সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চমৎকার যোগাযোগ রয়েছে, যা পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতকে সহজ করে তুলেছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি উৎপাদনে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানকার মাটি উর্বর এবং কৃষকরা অত্যন্ত কর্মঠ, যা ফসল উৎপাদনে ঈশ্বরদীকে এগিয়ে রেখেছে। এখানে আখ, সরিষা, এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। ঈশ্বরদী ২০ এবং ঈশ্বরদী ২৪ নামের উচ্চ ফলনশীল আখের জাত এখানকার কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়। সরিষা চাষের পাশাপাশি মধু উৎপাদনও এখানকার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা বিদেশি সবজি চাষেও সফল হচ্ছেন, যা স্থানীয় কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ঈশ্বরদীতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানিরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি উপকেন্দ্র রয়েছে, যা কৃষি গবেষণায় এবং কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ঈশ্বরদীর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পাকশী ইউনিয়ন, যা পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এবং তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। পাকশীর অবকাঠামোগুলো, বিশেষ করে লাল ইটের তৈরি বাড়িগুলো, ব্রিটেনের গ্রামীণ স্থাপত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রেলের অফিস এবং রেল কলোনিগুলো আজও তাদের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, যা দেখলে মনে হয় যেন সেদিনই তৈরি হয়েছে। পাকশীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এই ঐতিহাসিক সেতুটি পদ্মা নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং এর নির্মাণশৈলী ও গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া, লালন শাহ সেতু, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস, ঈশ্বরদী ই পি জেড, পাকশী রেলওয়ে স্টেশন, এগ্রোনোমিক ল্যাব, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পাকশী রিসোর্ট এখানকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান। এই স্থানগুলো পাকশীকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু ঈশ্বরদী বা পাবনা জেলার জন্য নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এই মেগা-প্রকল্পটি বাংলাদেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এক বিশাল ভূমিকা পালন করবে, যা দেশের বেকারত্ব সমস্যা লাঘবে অত্যন্ত সহায়ক হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে, যার মধ্যে প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, নির্মাণ শ্রমিক এবং সহায়ক কর্মী অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়াও, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য, যা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিশ্চিত করবে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী হবে। এটি বাংলাদেশের শিল্প খাতের সম্প্রসারণে, বিশেষ করে ভারী শিল্প এবং উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পে, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশে গড়ে ওঠা অবকাঠামো, যেমন রাস্তাঘাট, আবাসন এবং অন্যান্য পরিষেবা, স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি আনবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। এটি কেবল একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নয়, বরং জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের একটি কেন্দ্রবিন্দু। এর সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর কাতারে নিয়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। এই প্রকল্পটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

ঈশ্বরদী ও পাকশী শুধু পাবনা জেলার দুটি ভৌগোলিক এলাকা নয়, বরং বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতীক। এখানকার উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সুসংগঠিত যোগাযোগ অবকাঠামো, এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। বিশেষ করে পাকশীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এই অঞ্চলকে এক অনন্য পরিচিতি দিয়েছে। ঈশ্বরদী ও পাকশীর এই সমন্বিত রূপই এটিকে একটি আরামপ্রিয় এবং উন্নত জনপদে পরিণত করেছে, যা বাংলাদেশের সকলের কাছে পরিচিত এবং প্রশংসিত, এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এর ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির এক প্রধান চালিকাশক্তি।

এই বিভাগের আরও খবর

আজকের দিন-তারিখ

  • শুক্রবার (সন্ধ্যা ৬:৩৯)